মধ্যাহ্নের পরে হঠাৎ আলোর ঝলক

©Tanvir Parvez. Powered by Blogger.

আঁলিয়স ফ্রঁসেজে গত ২৯ শে মে শেষ হয়ে গেলো চারুকলা কলেজের শিক্ষকদের আয়োজতি চিত্র ও ভাস্কর্য প্রদর্শনী। বিলম্বে হলেও এ কথা সত্য সময়ের কাছে প্রতিশ্রুতি রাখতে আর্ট কলেজের শিক্ষকেরা এগিয়ে এসেছেন। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের হাজারও সমস্যার মাঝে কিছুটা আলোর আভাস ফুটতেই চারুকলা কলেজের শিক্ষকেরা যৌথভাবে চিত্র ও ভাস্কর্য প্রদর্শনীর যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

এ শহরে দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চারুকলা বিষয়ক। সেই জন্যেই পেশাগত কারণে সমকালে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত উজ্জ্বর বেশ কয়েকজন শিল্পী এ শহরে বাস করেন। কিন্ত্ত দু:খজনক হলেও একথা সত্য চট্টগ্রামে চিত্র প্রদর্শনী করার বেলায় শিল্পীরা প্রথম থেকেই কেমন যেন এক ধরনের হতাশাবোধ করে থাকেন। অনিয়মিত প্রদর্শনীর কারণে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিবেশে চিত্র ও ভাস্কর্যের গ্রহণযোগ্যতা ঠিক তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। অথচ সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। কেন হয়ে ওঠেনি। কেন হয়ে ওঠেনি নিয়মিত চিত্র প্রদর্শনী - এ প্রশ্ন নিশ্চয় পাঠকের মনে উদয় হবে। মূলতঃ চট্টগ্রামে যখন চিত্র কিংবা ভাস্কর্য চর্চা শুরু হয় তখন ঢাকায় মোটামুটি একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। এবং যেহেতু এখানে প্রথমদিকে যারা চারুকলার চর্চা শুরু করেন তারা প্রায় সকলেই ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে এসেছেন পেশাগত কারণে, ফলে তাদের মধ্যে ঢাকামুখী একটা মনোভাব সর্বদাই কার্যকর থাকে। পরবর্তীতে হয়তো এখানে নিয়মিত চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন হতে পারতো, কিন্ত্ত সমকালীন চিত্রকলার মান নির্ণায়ক সবগুলো প্রদর্শনী যেহেতু ঢাকায় হয়ে থাকে। এখানাকার পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরাও ঢাকায় প্রদর্শনীর ব্যাপারে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একথাও সত্য শিল্প রসিক কিংবা বোদ্ধাদের সমাগম সবসময়ই চট্টগ্রামের তুলনায় ঢাকায় বেশী। তাছাড়া ঢাকায় এ ধরনের পরিবেশের ব্যাপকতাও আছে। কিন্ত্ত আজ প্রায় দীর্ঘ ২৫/২৬ বছর ধরে চট্টগ্রামে নিয়মিত চিত্রি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলে, এ শহরও পিছিয়ে থাকতো না। ঢাকার মত এখানেও এতাদিনে বেশকিছু Galleryতৈরী হয়ে যেতে পারত ঠিক তেমনি শিল্প চর্চার পরিবেশগত ব্যাপকতাও বৃদ্ধি পেতো। এটাও স্বীকার্য প্রদর্শনীর আয়োজনের সাথে অর্থনৈতিক ব্যাপারও জড়িত। পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে এ শহর খুব যে পিছিয়ে তা কিন্ত্ত না। ইদানিং শিল্প শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন চিত্র প্রদর্শনীই তার প্রমাণ বহন করছে। অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক প্রদর্শনী ভিন্ন চট্টগ্রামে এখনো কোন বড় মাপের প্রদর্শনীর আয়োজন সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

এসব কারণেই বিলম্ব শব্দটা এ বর্তমান নিবন্ধের শুরুতেই লিখতে হলো।

চারুকলা কলেজের শিক্ষকদের আয়োজিত এ প্রদর্শনী সমযের কাছে তাঁদরে যেমন দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর। ঠিক তেমনি ভবিষ্যতের কাছেও তারা আর বেশি দায়বদ্ধ হয়ে গেলেন নিয়মিত প্রদর্মনী আয়োজনের ব্যাপারে। সেই সাথে এ কথাও বুঝতে হবে চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্য শিল্পীদের কাঁধেও একটা দায়িত্বের বোঝা চারুকলা কলেজের শিক্ষকেরা চাপিয়ে দিলেন। সময় আর স্থানের কাছে প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রাখতে তারা কি নির্বোধের পরিচয় দিবেন? না সচল হয়ে এগিয়ে আসবেন সেই উত্তর ভবিষ্যত দিবে।

এবার আসা যাক প্রদর্শনী প্রসঙ্গে। আঁলিয়স ফ্রঁসেজে চারুকলা কলেজের শিক্ষকদের চিত্র ও ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে সর্বমোট ২৮টি চিত্রকর্ম ৩টি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে। অনেকগুলো চিত্র কর্মের সাথে শিল্প রসিকগণ নিশ্চয় আগে পরিচিত।  সে কারণে বিপুল অভিনবত্যের সন্ধান প্রদর্শনীতে মেলেনি। তবে সূচনা প্রদর্শনী হিসেবে বিবেচনা করলে এই দোষের ভাব দেওয়া যায় না। প্রদর্শনীতে নয়জন শিল্পীর কাজের মাঝে লায়লা মনসুর নাজলীর কাজের মাঝে লায়লা মনসুর নাজলীর Vile Counterfeit Simple ছবিটি প্রথমে দৃষ্টি কারে। কারণ ছবিটার আয়োজন অভিনব, জানালার কপাটের ভেতরে বাহির দু’টি Painting এর স্বাদ পাওয়া যায়। আবার সমগ্র Painting টি মিলিয়ে একটি Painting এর স্বাদও রচনা করেছেন শিল্প। Painting টিতে শিল্পী যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সরলতাকে পুরণ করে এর এক রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি অভিজাত পরিমন্ডেলের পাশে ফুটে উঠেছে সাধারণ ভেটে খাওয়া মানুষদের জীবন যাত্রা। এখানে এক ধরনের শ্রেণী বিভেদের প্রতি শিল্পীর কটাক্ষ দৃষ্টির ইঙ্গিত মেলে। শিল্পকর্মটি Plywood এর  Surface এর উপর তেল রং এ রচিত হয়েছে। শিল্পকর্মের আয়োজন রং ব্যবহারের বিচক্ষণতা শিল্পীর বাকী দু’টি শিল্প কর্মেও প্রতীয়মান হয়। শিল্পী লায়লা মনসুর নাজলীর কাজের Form বিন্যাস Speac এর ব্যবহার সর্বোপরি পুরো রচনা শৈলীতে তিনি কোথায় যেন এক ধরনের স্বদেশিকতা ফুটিযে তোলেন যা তার একান্ত নিজস্ব। তিনি কল্পনা বিলাসী শিল্পী নন বরং তার কাজে যে গল্প বলার ঢং তা শহরে তার অবস্থানগত পরিবেশকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

শিল্পী কে. এম. এ কাইয়ুমের শিল্পকর্মের সাথে শিল্প রসিকগণ আগেই পরিচিত্ একটি সমতল Speac এর পাশে সুক্ষ্ম বুনট রচনায় যে বৈপরীত্য যে অভিনবত্য ফুটে উঠে তা তার বলিষ্ঠ শিল্প শৈলীর পরিচয় বহন করে। প্রদর্শনীতে Organic Form এ রচিত Nature-6 শিল্প কর্মটি চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা দর্শকের স্মৃতিতে জাগ্রত করে। স্থবির Form এর পাশাপাশি উজ্জ্বল রেখা আর গতিশীল ঋঙজগ ব্যবহার প্রাণহীনতার মাঝে প্রাণের সঞ্চারণ ঘটায়।। মূলত শিল্পী কাইয়ুমের শিল্পকর্মে প্রাকৃতিক  বৈষম্যের মাঝে ছন্দময় সমন্বয় ব্যঞ্জনা রচনা করে।

চারুকলা কলেজের Industrial Arts বিভাগের  Lecturer সৌমেন দাস তার চিত্র রচনায় ইদানিং এক নতুনত্ব আনার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। আমরা তার আগের চিত্রকর্মে দেখেছি তিনি রেখাদিয়ে  এক ধরনের আলঙ্কারিক রূপ সৃষ্টিতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্ত্ত এ প্রদর্শনীতে তার ভিন্ন পরিচয় মেলে। রং এর ওয়াসের মাঝে তিনি কাজ করেছেন এখানে।

নতুন যারা চারুকলা কলেজে শিক্ষক পদের যোগ দিয়েছেন তাদের মাঝে জসিম উদ্দিনের কাজ উল্লেখযোগ্য। ছাপচিত্র রচনায় তার কাজে কৌশলঘত নতুনত্ব আছে। তার আঁকা Firststep চিত্রগুলোতে নিজস্ব অনুশীলনের প্রথমধাপ রূপায়নে বক্তব্য উজ্জ্বল। পাথর, কাঠের সমন্বিত ছাপানোর ফলে কৌশলগত ভিন্নতার সন্ধান মেলে।  Print নেবার জন্য তিনি যে Surface ব্যবহার করেছেন তার ভাষায় সেটি এক ধরনের কাপড়। কিন্ত্ত পেপার পেষ্টিং এর উপর Print নিলেও এ ধরনের Feffect পাওয়া যানে আমার ধারণ।

সুফিয়া বেগম আর নাহিদা শারমিন এর মোট ৮টি শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে ছিল। নাহিদা শারমিনের Song of Loneliness এবং সুফিয়া বেগমের Post Meridian কাজগুলো শিল্পের যাত্রাপথে প্রথম পদক্ষেপ বলেই মনে হয়। এখানে এ কথাও স্বীকার্য চিত্র রচনায় এই নবীন শিক্ষকেরা শিল্পী মনসুর উল করিমের কাছে কৃতজ্ঞ।

প্রণবের ভাস্কর্যে খুঁজে পাওয়া যায়নি তিনি কোন ধারায় প্রকৃতপক্ষে বিচরণে ইচ্ছুক। এছাড়া শাহারুল হায়দার ও নাছিমা আক্তার চিত্র রচনায় তাদের নীরবতা ভেঙ্গেছেন এটাই আশার কথা।

প্রদর্শনী পরিকল্পনায় শিল্পীরা আরো যত্নবান হতে পারতেন। যাই হোক এ ধরনের একটি প্রদর্শনী চট্টগ্রামের শিল্প রসিকদের হৃদয়ে তৃপ্তি না দিতে পারলেও মধ্যাহ্নের পরে এই প্রদর্শনী শিল্প রসিকগণের হৃদয়ে আশার আলোর সঞ্চারণ ঘটাতে পেরেছে। এখানে বলাবাহুল্য মহৎ উদ্যোগের মাঝে ভুল ভ্রান্তিগুলো অবশ্য ক্ষমার যোগ্য।

প্রথম প্রকাশনা: দৈনিক স্বাধীনতা। ২০ জুন ১৯৯৫


0 comments:

Post a Comment