
চট্টগ্রামে চারুকলা কলেজ প্রাঙ্গণে আয়োজিত দ্বাদশ নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীতে ২২৭টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। প্রায় অর্ধ সহস্রাধিকের চেয়ে বেশি শিল্পকর্মের মধ্য থেকে ৫ জন বিচারক এই শিল্পকর্ম নির্বাচনের কাজটি পরিচালনা করেন। বাছাইপর্ব মূলত শিল্পকর্মের কালার স্লাইড কিংবা ফটোগ্রাফ থেকে করা হয় বলে এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটি কিছুটা কঠিন।
প্রদর্শনী উপভোগ করার পর কিছু প্রশ্ন উত্থাপনের তাগিত অনুভব করছি। সেই সঙ্গে এ কথাও জানানো আবশ্যক মনে করছি যে রঙিন ফটোগ্রাম কিংবা স্লাইডের সীমাবদ্ধতার ভেতরেও নিচে বলা বিষয়গুলো বোধ হয় অনুধাবন কঠিন নয়। এক, শিল্পকর্মটি কি মূলস্রোতের প্রতিনিধিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে, নাকি গতানুগতিকের প্রতিফলন? দুই, নিরীক্ষার অগ্রগামিতার সাহসী পদক্ষেপ, নাকি একাডেমীক রূঢ়তায় পূর্ণ। কিন্তু প্রদর্শনী দেখলে নির্বাচকগণের এ সব বিষয়ে উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। ফলে কিছু ভালো কাজের সঙ্গে মানদন্ডের বহু নিম্নমানের পর্বের কাজও প্রদর্শনীতে স্থান করে নিয়েছে আর তাই ভালো কাজগুলো অনুধাবন করা দর্শকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না শিল্পকর্মের ডিসপ্লেও দর্শকের জন্য শিল্পকর্ম অনুধাবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। প্রদর্শনীর কোনো কোনো কক্ষে সময় নিয়ে শিল্পকর্ম উপভোগ করা বড়োই কঠিন হয়ে পড়ে। এসব বিষযে আরো যত্নবান হওয়া প্রয়োজন ছিল।
প্রদর্শনীর প্রথম কক্ষটি অতিক্রম করলে প্রথমেই চোখে পরে নাসিমা হক মিতুর জ্যোতির্ময় প্রতিভার স্বাক্ষর ভাস্কর্য রচনা-১, মিতুর কাজে প্রাচ্য প্রতীকময়তার স্বাক্ষর রয়েছে। একটি গ্লাসের উপর উপবিষ্ট সেই ভাস্কর্যটি কোথায় যেন শিবলিঙ্গের স্মৃতি আমাদের মনে জাগ্রত করে। মূল প্রবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত নব নিরীক্ষার এই কাজটি বোদ্ধা রসিককে নাড়া দেয়, আর কিছু ভালেরা কাজের মাঝে আহমেদ নাজিরের ‘অতীতের দায়’ কিংবা মোহাম্মদ মোস্তফা শহীদুল ইসলাম ‘যখন মৃত্তিকার সাথে কথ হয়’, মাসুদ কবিরের ‘নারী-২’ কিংবা নাফিস আহমেদের ‘শিরোনামহীন’ উল্লেখ করা যেতে পারে।
পুরস্কৃত শিল্পের ব্যাপারে ইতিপূর্বে বহুবিধ মত উত্থাপন হয়েছে। প্রথমে দৃষ্টিকটু লাগে গতানুগতিক একটি একাডেমীক কাজকে পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি। তারপর পাশ্চাত্যের স্বীকৃত শিল্পীদের কাজের দায়ে পাশ্চাত্য অভিধায় উপস্থাপিত মাহাবুবুর রহমান ও জসিম উদ্দিনের কাজ। কিংবা ওসমান পাশা ও তাসাদ্দুক হোসেন দুলুর কাজে স্বদেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কাজের পুনরাবর্তন দেখে প্রাসঙ্গিকভাবে এ কথা বলা যায় বেশিরভাগ পুরস্কৃত শিল্পই ছিল শিল্পযাত্রার আবর্তন; সাহসী কোনো পদক্ষেপ কিংবা জ্যোতির্ময় প্রতিভার ছাপ সেখানে পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে আগামী প্রদর্শনীর জন্য তৈরি হওয়া নবীন শিল্পীদের কাছে শিল্পরচনা করার পথটি বড়ো বেশি দ্বিধাপূর্ণ হয়ে উঠলো।
এসব বিষয়ে দীর্ঘদিনের নিরাশার পর্বটি কাটিয়ে উঠতে একাডেমীকে অবশ্যই লক্ষ্যহীন আয়োজন করলে চলবে না। বরং এ কথা পরিস্কারভাবে জানাতে হবে, নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীর মূল লক্ষ কী? এবং সেই লক্ষ্যের উদ্দেশ্য হবে আমাদের প্রতিভাময় নবীন উদ্ভাবক শিল্পীদের খুঁজে বের করা। আর তাই শিল্পকর্ম নির্বাচন ও পুরস্কৃত করার বিষযে সকলকে জানিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। সেইসঙ্গে গত ‘নবীন জাতীয় কিংবা এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম বিচার কিংবা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কার্য কমিটির দুর্বল প্রদর্শনীর আয়োজিত স্মৃতি মনে রেখেই একথা উত্থাপন আবশ্যক যে এসব কমিটিতে একই ব্যক্তি যেন দীর্ঘদিন অবস্থান না করে। এই দ্বাদশ নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীসহ গত প্রদর্শনীগুলোর স্মৃতি ধারণ করেই বলতে হচ্ছে নবীনদের স্বার্থরক্ষার চেয়ে সময়ের স্বার্থরক্ষা যদি প্রধান ভূমিকাপূর্ণ হয়ে পরে তাহলে দেশ হারাবে বহু প্রতিভার জ্যোতি। তাই এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, রাজনৈতিক অস্থিরতাপূর্ণ তৃতীয় বিশ্বের এই দেশটির জন্য সৃষ্টিশীল নবীন শিল্পী আজ বড়ো প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত হবে রুচির পথে, সভ্যতার অগ্রগামী পথে। শিল্পকলা একাডেমীর কাছেই এই সৃষ্টিশীল মানুষের স্বীকৃতি প্রদানের বিশাল ভূমিকাটুকু অর্পিত। তাই সমালোচনার উর্ধে উঠে বর্তমান সফলতাকে ধারণ করে, আগের ত্রুটি শুধরে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রথম প্রকাশনা: দৈনিক ভোরের কাগজ, ০৫ মে ১৯৯৮
0 comments:
Post a Comment