বাণিজ্যিক সংস্থার পরিচয় উপস্থাপনে ব্যবহৃত অলংকরণ রুপায়নে সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা

©Tanvir Parvez. Powered by Blogger.
খুব সম্প্রতি কোন এক ব্যাংকের বর্ষ শুভেচ্ছা বিজ্ঞাপনের দৃশ্য উপস্থাপনে স্বনামধন্য একটি  বিদেশী সুগন্ধির বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত দৃশ্যটি সরাসরি  উপস্থাপনে করে সংবাদ পত্র সহ সকল সোশাল মিডিয়াতে বেশ সারা ফেলে  দিয়েছে। সবাই খুব হাসাহাসি করেছে ব্র্যান্ড ম্যানেজার, ভিজুয়ালাইজার ইত্যাদি নানান লোকদের বংশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর বেশ কিছুদিন আগে আমরা শুনেছি কোন এক দেশী টেলিভিশন চ্যানেলের  লোগো হুবহু অন্য একটি জনপ্রিয় বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলের  লোগো থেকে কপি করে উপস্থাপন করা হয়েছে। বস্তুত: এই দেশে এ ধরনের ঘটনার উদাহরণ এবং বিবরণ সহস্র উপস্থাপন করা যাবে। ঘটনা ঘটার পরে বিষয়টি নিয়ে সবাই কিছুদিন হাসাহাসি করে তারপর ভুলে যায়।

অথচ বহুল জনবসতির এ দেশে শিল্পের এই খাতকে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে নতুন সম্ভাবনার উন্মীলন ঘটানো সম্ভব। অন্য দিকে আমাদের স্বদেশী বাণিজ্যিক সংস্থা গুলো আজ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে পা বাড়িয়েছে তাদের পরিচিতিকে আর জ্যোতির্ময় করার কাজটি নির্ভর করে এই খাতে আর তাই আরও বেশী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে আমাদের। অথচ সম্প্রতি কালের আমাদের দেশী বিজ্ঞাপন চিত্রে কিংবা বাণিজ্যিক সংস্থার পরিচয় পূর্ণ অলংকরণে ব্যবহৃত দৃশ্যগত উপস্থাপন এতো বেশী আশ্রয় নির্ভর হয়ে উঠেছে যে, দেখেই মনে হয় কোথায় যেন দেখেছি। ইন্টারনেটের  কারণে সকল ইনফরমেশনই আজ হাতের মুঠোয়। তাই কাকের মত চোখ বন্ধ রেখে কোন কিছু লুকিয়ে রাখার মাঝে সাময়িক তৃপ্তি মিলবে হয়তো কিন্তু দায়বদ্ধতা, দায়িত্বহীন আচরণের কারণেই আমাদের পরিচয় সংকটের উদ্ভব হবে। অন্যদিকে,আমাদের স্বদেশেই এ পথটি কানা গলিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই আজ সময় এসেছে এমনটা হওয়ার প্রকৃত কারণটা অনুসন্ধানের।
মূলত: গত দুই দশকে আমাদের দেশে  কম্পিউটারের ব্যাবহার শুরু হয়। সেই সাথে এদেশের মুদ্রণ শিল্পেরও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে এখানে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সূত্রপাত ঘটে কিছু অপারেটরে বা টেকনিক্যাল লোকের হাত ধরে। যাদের, শিল্প বা শিল্পকলা বিষয়ক কোন  জ্ঞানই ছিল না। কিছু টেকনিক্যাল লোক তাদের অপারেটিং  জ্ঞানটাকে নির্ভর করে আর্ট ডিরেক্ট শনের পদটিও অলংকৃত করে ফেলে, ফলে শৈল্পিক উৎকর্ষতা  বিবর্জিত রঙিন কিছু ঝকমকি মোড়কের আবির্ভাব ঘটে কিন্তু প্রজ্ঞা-গত উৎকর্ষতা কোন নিদর্শনই আর উদ্ভব হয়নি।
কাল অতিক্রম হলে কিছু শিল্প বিষয় শিক্ষার্থী তাদের আপন চেষ্টায় অপারেটরের কাছ থেকে টেকনিক্যাল দিকটা আয়ত্ত  করে বৈ-কি।  কিন্তু অপারেটরের কাছে পাওয়া সীমাবদ্ধ  জ্ঞান নিয়ে তার চর্চিত দীর্ঘ দিনের দৃশ্যগত অভিজ্ঞতাকে যান্ত্রিক মাধ্যমের দক্ষতা দিয়ে উপস্থাপন তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। অন্যদিকে কম্পিউটারের মত অভিনব একটি যন্ত্রের দীর্ঘ সম্ভাবনাময়  উৎকর্ষতা, তারপর ইন্টারনেটে  গ্রাফিক্সের উপাদানের সহজলভ্যতার কারণে  ক্রমান্বয়ে সে তার পথ হারিয়ে ভিন্ন পথে পা বাড়ায়। স্থান, কাল, বিষয় গত দিকটি ভুলে প্রজেক্টটি শেষ করাই তার কাছে একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। আবার ক্লায়েন্ট এর কাছ থেকে কাজের প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য ডকুমেন্টে বর্ণিত দৃশ্যগত উপস্থাপনে অনভিজ্ঞ ক্লায়েন্ট এর  মুগ্ধতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেক সময় শিল্প নির্দেশনার কথা মাথায় প্রশ্রয় দেয়া যায় না। বেশীর ভাগ সময় ক্লায়েন্ট একটা নিদর্শন তৈরি করে এনে প্রকাশ উপযোগী করার জন্য ডিজাইনারের হাতে তুলে দেয়। অথবা নেট থেকে ডাউন লোড করা একটি পরিপূর্ণ কপি তৈরি করে দিতে বলে। হোক সেটা আরব মরুভূমিতে উত্তর মেরুর সাদা ভাল্লুকের হাটার মত উৎকট ঘটনা। ক্ল্যায়েন্ট এর মতের প্রাধান্য দিতে গিয়ে ডিজাইনার বা আর্ট ডিরেক্টর সেখানে কালক্রমে অপারেটরে পরিণত হয়। আর আমাদের সম্ভাবনায় ক্রমেই আঁধার ঘনিয়ে আসে।
আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য বিবেচনা করলে দৃশ্য উপস্থাপনের  দৈনতা আমাদের দেশে কখনো ছিল না।  সভ্যতার ইতিহাস থেকে আমাদের অন্তত এই ধারনা পরিষ্কার যে, চর্যাপদের ক্যালিগ্রাফি, প্রাচীন সেইসব মুদ্রা , চালচিত্র, পুথিতে অলংকরণ - এক রাজ্যের ইতিহাস আমাদের। এখানে উল্লেখ্য, চালচিত্র,গাজির পট কিংবা লক্ষ্মীর সরায় আমাদের যে ব্রান্ডিং উৎকর্ষতার ঐতিহ্য তা পাশ্চাত্যের  পপ যুগে নিউইয়র্ক কিংবা কোকা কোলার ব্রান্ডিং ঐতিহ্যের চেয়ে  কোন অংশেই কম না।    কিন্তু তবুও আমরা কেন এই দৈনতায় ভুগছি। মূলত: আমাদের আত্মবিশ্বাস কি হারিয়ে গেছে?  বৈশ্বিক হতে হলে গায়ের চামড়া সাদা করার প্রয়োজন নেই, এ কথা সবাই জানে; প্রয়োজন অন্তঃ আলোর দীপ্তিময় উন্মীলন। সৃষ্টির প্রাচুর্য স্রষ্টার কাছেই থাকে, স্রষ্টা অগ্রসর হন নিজের অভিজ্ঞতার পথ ধরে । পরবর্তী অভিযাত্রা স্বাভাবিক ভাবেই অভিনব থেকে অভিনবত্বর হয়ে ওঠে।
ইনফরমেশন আমাদের সমৃদ্ধ করে । লক্ষে পৌঁছাতে সহায়তা দেয়, সময়ের অলিগলি চিনতে সহ্য করে, কিন্তু তার আর্থ এই না চরিত্রের নাম পাল্টে দিয়ে ঐতিহ্য, অবস্থান, সংস্কৃতিকে ভুলে কোন কিছু উপস্থাপনের মাধ্যমে অভিনবত্বের সন্ধান মিলবে।
উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ সময় পূর্ববর্তী পরি-ভ্রামকের অভিজ্ঞতাকে আয়ত্ত করে পরবর্তী অভিযাত্রীরা অগ্রসর হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সেই সাথে ভুলে গেলে চলবে না যে , পূর্ববর্তী  পরি-ভ্রামকের বর্ণিত  অভিজ্ঞতা অনেক সময়েই  অভিযাত্রীদের লক্ষ পথের সাথে বৈরী আবহাওয়া কিংবা ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন জনিত কারণে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়ে উঠতে পারে । তাই যাত্রাপথে নিজের অবস্থান, কালের মোকাবেলার কথা ভুলে গেলে বৈশ্বিক হওয়া তো দূরের কথা নিজের যাত্রাটিও আর কখনোই লক্ষের পথ খুঁজে পাবে না। সেই সাথে মনে রাখতে হবে একটি সংগীতের কথাগুলো গীতিকারই লিখবে, সূর করবে একজন সুরকার আর গানটি গাইবে একজন গায়ক এই পথটিই স্বাভাবিক। স্ব:স্ব: অবস্থানের কাজটি সবাই নিজ নিজ দায়িত্বশীলতার পরিচয়ের মাঝেই উৎকর্ষতার শিখরে পৌঁছা স্বাভাবিক । এই স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করলে প্রতিনিয়ত আমাদের এইসব ভুলভাল হওয়াটা নিয়তি বলে মেনে নিতে হবে।
দেশের অগ্রযাত্রায় এই শিল্পটি বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে । তাই দায়িত্বশীলতা আর নিজস্ব স্থানগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভিন্ন মাত্রার পরিচয় তৈরি করার মাঝেই এপথে শিখরে উঠতে হবে । তখন বিশ্বের দৃষ্টি অবশ্যই আমাদের দিকে ঘুরে তাকাবে ।  নতুবা গল্পের সেই চরুই পাখির মত হবে  । বাবুই পাখির চেয়ে ঢের সুন্দর বাসা বাঁধার অভিজ্ঞতা নিয়েও অন্যের বাড়িতে থাকতে হবে । তাই সময় হয়েছে ফেলে আসা ভুলভাল গুল ভুলে গিয়ে ভিন্ন মাত্রার পরিচয় তৈরি করে নতুন পথে যাত্রার ।


1 comments:

  • Unknown says:
    January 20, 2013 at 3:41 PM

    সত্য কথা

Post a Comment