বিশ্বজুড়ে আজ বাজার অর্থনীতি ও ভোগবাদিতার উৎসব চলছে, যা মানুষের সংবেদনশীলতাকে গ্রাস করে তার অসহায়ত্বের ভূগোলটিকে বিস্তার করছে। জীবন ও জগতের পরিচর্যা করার যে দায়ভার শিল্পের ছিল শিল্পীরা থেকে সরে যাচ্ছেন এবং শিল্পচর্চার অধিকাংশই শিল্প নামে অবজেক্ট করণকৌশলজাত বস্তুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এ প্রবণতা অপেক্ষাকৃতভাবে কর্তৃত্বপরায়ণ। এর একটি বড় কারণ হয়তো ঔপনিবেশিকতা। উপনিবেশিকতার সবচেয়ে বড় সঙ্কট পরনির্ভরশীলতা যা একটি জাতির সৃজনশীল মননকে ভেতর থেকে স্তব্ধ করে দেয়। ফ্রানৎস ফানোঁ বলেছিলেন, কলোনিয়ালিজম ইজ নট স্যাটিসফায়েড মেয়ারলি উইথ হোল্ডিং আ পিপল ইন ইটস গ্রিপ অ্যান্ড এম্পটিয়িং দ্য ন্যাটিভস ব্রেইন অব অল ফরম অ্যান্ড কনটেন্ট । আমাদের মেধা ও মননের প্রায় সব জায়গাতেই এটি স্পষ্ট। এক্ষেত্রে উপনিবেশোত্তর দেশগুলোর মধ্যে একটা সাদৃশ্য পাওয়া যাবে। তবে এরই মধ্যে এই উপনিবেশজাত হীনম্মন্যতার পাঁচিল ভেঙে নিজেদের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সৃজনশীলতার নতুন ভুবন প্রতিষ্ঠার উদাহরণও সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর আমেরিকার বেশ কটি দেশ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতও অনেকটা পথ অতিক্রম করে গেছে। জানি না, আমাদের অক্ষমতার এই দায়ভার আর কতকাল ঔপনিবেশিকতার ভূতটির ঘাড়ে চাপিয়ে যেতে হবে।
ওপরের কথাগুলো লিখতে হলো কারণ আমাদের শিল্পে নতুন ভাব ও ভাষার বড় অভাব। অনেক তরুণের মধ্যেই হয়তো সেই সুপ্ত সম্ভাবনা আছে যা আমাদের ভবিষ্যৎ শিল্পকলাকে আরো সমৃদ্ধ করবে। প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচর্যার। এ দশকেই কয়েকজন তরুণের মধ্যে সেই উৎক্রান্তির লক্ষণ দেখা গেছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রথার দিকে ধাবিত হয়েছে । দুই তরুণের প্রদর্শনী নিয়ে আজ লেখার এটিও একটি কারণ।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউটের জয়নুল গ্যালারিতে সৈয়দ আজিজুর রহমান ও তানভীর পারভেজ এ দুই তরুণের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী শেষ হয়ে গেল । দুজনের কাজে ভিন্নতা থাকলেও শিল্পভাবনায় সাদৃশ্য রয়েছে। দুজনই শিল্পকে তাদের ভাবনার সমান্তরাল দেখতে ইচ্ছুক। তাই হয়তো তারা তাদের প্রদর্শনীটির শিরোনাম দিয়েছেন 'স্পেস- স্পেসিফিক আর্ট'। আবার ভাব ও প্রকাশের রূপ আলাদা হওয়ায় নিজেদের কাজগুলোর আলাদা শিরোনামও তারা দিয়েছেন। তানভীর পারভেজ তার প্রদর্শনীর নাম দিয়েছেন ‘হোয়েন রিয়েলিটি অ্যাপিয়ার্স ট্রান্সপ্যারেন্ট', আজিজুর রহমান দিয়েছেন ‘মেন্ডারিং ইন দ্য কনজ্যুমার কালচার'। তাদের প্রদর্শনীর উদ্বোধনীও ছিল অনুষ্ঠানবিহীন ও অনাড়ম্বর । ফলে কোনো প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ওদের প্রয়োজন হয়নি। প্রদর্শনীতে তানভীর পারভেজের ছিল হাতেগোনা কয়েকটি পেইন্টিং ও দুটো স্থাপনা; আর আজিজুর রহমানের মূলতই স্থাপনা, তবে তার অনুসঙ্গ হিসেবে ছিল দুটো পেইটিং ।
পারভেজের মূল বিষয়, তার শিরোনাম অনুযায়ী, বাস্তবতা যখন স্বচ্ছতায় দৃশ্যমান । বস্তুত পারভেজের কাছে বাস্তবতা যতই স্বচ্ছ হোক না কেন তার নির্মিত ক্যানভাস ততটা স্বচ্ছ নয়, বরং খানিকটা জটিল : একদিকে মূর্ত এবং বিমূর্ততার টানাপোড়েন, অন্যদিকে উষ্ণ রং ও নিরপেক্ষ সাদা-কালোর বৈপরীত্য। এছাড়া অসংবৃত মানবদেহের সঙ্গে অতিপরিচিত রাজহংসের অতিকায় গ্রীবা ছবির সংস্থাপনায় কৌণিক টানাপোড়েনের মাধ্যমে নাটকীয় কম্পমানতা সৃষ্টি করেছে। প্রকাশভঙ্গিতে জটিলতা থাকলেও পারভেজ যে বাস্তবতাকে, অর্থাৎ ঘটমান বাস্তবতার পাশবিকতাকে, উপলব্ধি করেছেন তা বিম্বিত হয়েছে তার কাজে। সে কারণেই হয়তো পারভেজ তার শিল্পকর্মের নাম দিয়েছেন হোয়েন রিয়েলিটি অ্যাপিয়ার্স ট্রান্সপ্যারেন্ট'। পারভেজ সচেতনভাবেই কৌলিন মাধ্যম উপকরণগুলোকে এড়িয়ে গেছেন ক্যানভাসের পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন স্বচ্ছ পলিথিন। তার পেছনে গ্লাস পেইন্টিংয়ের মতো জলজ নানা মিশ্ররঙের ওপর কাগজ সেঁটে ছবির তল নির্মাণ করা হয়েছে।
পারভেজের একটি স্থাপনা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। একটি বায়োস্কোপ বাক্সের মধ্যে তিনটি ভিউ- ফাইন্ডারে ক্রমান্বয়ে লেখা আছে 'আর্ট-সিম্পল আর্ট-আর্ট'। তাতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এডওয়ার্ড মানের 'ঘাসের ওপর মধ্যাহ্নভোজ', বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর আঁকা নারী এবং পিকাসোর 'এভিগননের রমণীরা' ছবিগুলোর সাদাকালো অনুলিপি। সমঝদার দর্শক সহজেই বুঝে নিতে পারবেন কোনটি শিল্প আর কোনটি নিরেট শিল্প নামক অবজেক্ট। এটির তুলনায় দ্বিতীয় স্থাপনাটি বেশ দুর্বল। ইমেজের তুলনায় আয়োজন বেশ কর্তৃত্বপরায়ণ। ফলে ভাবের চেয়ে তাতে প্রকাশের ভার বেশি হয়ে পড়েছে। এছাড়া আকারে ক্ষুদ্র অনেকগুলো ছবির সম্মিলনে একটি ছবির আদল তৈরির ব্যাপারটিও পারভেজের চিত্রস্বভাবের সঙ্গে অসমঞ্জস। বরং ছবিগুলো আলাদাভাবে স্থাপন করা হলে ছবির ভাব উপভোগ্য হতে পারত।
সৈয়দ আজিজুর রহমানের স্থাপনার বিষয় মূলত বর্তমান সময়ের ভোগবাদী সংস্কৃতি । গ্যালারিতে ঢুকেই দর্শক বেশ সচকিত হবেন । এই শিল্পকর্মগুলো দর্শকের শিল্পসম্পর্কিত পূর্বধারণার বিপরীত। বড় থেকে ছোট বা ছোট থেকে বড় এই ক্রমে সাজানো অনেকগুলোপেকেজিং বাক্সের গায়ে মানবদেহের আকৃতি ও মুখ এবং পণ্য বোঝাই বাক্সের গায়ে প্রাসঙ্গিক লেখা। দর্শক যতই মনোযোগ নিবিষ্ট করবেন বাক্সগুলোর মর্মার্থ ততই খোলাসা হতে থাকবে, ততই তারা আজিজের অভিব্যক্তির কাছাকাছি হতে থাকবেন। বাক্সগুলো যেন মানুষের ভোগ- আসক্তির কারাগার। এ ধরনের বাক্সের গায়ে সাধারণত যেসব লেখা থাকে যেমন 'ফ্র্যাজাইল'- মানবদেহের আকৃতি-সম্বলিত এ লেখা আর পূর্ব অর্থে সীমাবদ্ধ থাকে না, প্রতীকী তাৎপর্যে তা অন্য অর্থে রূপান্তরিত হয়। এ শিল্পকর্মটিকে আজিজ স্থাননির্দিষ্ট করার প্রয়াসী হলেও স্থাপনাটি স্থানাভাবে ভাবপ্রকাশে খানিকটা পিষ্টই বটে। স্থাপনার অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত আজিজের চিত্র দুটো আমাদের তথাকথিত নান্দনিক বিচারেও চমৎকার। লাল-কালো বিমূর্ত চিত্রটির সামনে একটি মাউথপিস বসানো হয়েছে। এটি কি কোনো আনুষ্ঠানিকতার ইঙ্গিত, নাকি বিমূর্ত চিত্র নিয়ে খুনসুটি?
চিন্তার ঐক্য থাকলেও শিল্পী দুজনের কাজের ধরনের কারণে একই গ্যালারিতে প্রদর্শনীটি যথাযথ মনে হয়নি। তবু এই দুই তরুণের বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সীমাবদ্ধতা এবং অক্ষমতা শত্রুতা করে আসছে সৃজনশীল মানুষের সঙ্গে। একে অতিক্রম করাই একজন সৃজনশীল ব্যক্তির কাজ। এ লেখাটির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বলে চিত্রকলা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা দিয়ে শেষ করছি :
যে-সব গুণীর সৃষ্টিতে রূপ আপনার প্রমাণে, ভাব আপনার লাবণ্যে, প্রতিষ্ঠিত হইয়া আসিয়াছে তাহারাই ক্লাসিক হইয়াছে। তাহারাই নিত্য হইয়াছে। অতএব চিত্রকলায় ওস্তাদের ওস্তাদি, রূপে ও ভাবে তেমন নয়, যেমন প্রমাণে ও লাবণ্যে। এই সত্য ওজনের আন্দাজটি পুঁথিগত বিদ্যায় পাইবার জো নাই। ইহাতে স্বাভাবিক প্রতিভার দরকার। দৈহিক ওজনবোধটি স্বাভাবিক হইয়া উঠিলে তবেই চলা সহজ হয়। তবে নতুন নতুন বাধায় পথের নতুন নতুন আঁকেবাঁকে আমরা দেহের গতিটাকে অনায়াসে বাহিরের অবস্থার সঙ্গে তানে লয়ে মিলাইয়া চলিতে পারি। এই ওজনবোধ একেবারে ভেতরের জিনিস যদি না হয় তবে রেলগাড়ির মতো একই বাঁধা রাস্তায় কলের টানে চলিতে হয়। এক ইঞ্চি ডাইনে বাঁয়ে হেলিলেই সর্বনাশ। তেমনি রূপ ও ভাবের সম্বন্ধে যার ওজনবোধ অন্তরের জিনিস সে ‘নব-নবোনোষশালিনী বুদ্ধির পথে করা সৃষ্টিকে চালাইতে পারে। যা সে বোধ নাই সে ভয়ে ভয়ে একই বাঁধা রাস্তায় ঠিক এক লাইনে চলিয়া পোটো হইয়া কারিগর হইয়া ওঠে। সে সীমার সঙ্গে সীমার নতুন সম্বন্ধ জমাইতে পারে না। এইজন্য নতুন সম্বন্ধমাত্রকে সে বাঘের মতো দেখে।